ডা. সেলিম শাহেদ
বি-দেশ নিউজ, ঢাকা:
আমাদের দেশের জনৈক সাংবাদিক বলেছিলেন রোগীর গায়ে হাত না দিয়ে জানালা দিয়ে শুনে শুনে করোনার চিকিৎসা করা যায়, অত্যন্ত আশাবাদী এম্পি বলেছিলেন শুকনা মরিচ দিয়ে ডলে ভাত খেলে করোনা হবে না! এবং এখন বাস্তবতা হলো আমাদের দেশে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া রোগী বারো হাজার ছুঁই ছুঁই।
অন্যদিকে পাঁচ মাসে করোনায় ভুটানে মৃত্যু হয়েছে মাত্র একজনের। তাও একদম শুরুর দিকে।ভুটান পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুদ্র অর্থনীতির দেশগুলোর একটা। কৃষি, পর্যটন আর ভারতকে জলবিদ্যুৎ বিক্রি করা ছাড়া ভুটানের আর কোনও বড় ‘সোর্স অফ ইনকাম নেই’।
অনেক নেই এর মধ্যেও কিন্তু যে জিনিসটা আছে, সেটা হল সদিচ্ছা। মাত্র ১৬দিনে এ পর্যন্ত গোটা প্রাপ্তবয়স্কদের ৯৬ শতাংশকে টিকা দেওয়ার কাজ সেরে ফেলেছে ভুটান। বাদ গেছেন গর্ভবতী মহিলারা এবং অন্যান্য সংক্রামক রোগে ভুগছেন, এমন রোগীরা। টেকনিক্যাল কারণেই এই মুহূর্তে টিকা দেওয়া সম্ভব নয় যাদের। যদিও তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ভুটানেও টিকা নেওয়ার ব্যাপারে লোকের মনে নানা ভ্রান্ত ধারণা এবং সংশয় ছিল।
ভুটানে কোনও রেলপথ নেই। সরকার এবং সেদেশের স্বেচ্ছাসেবকরা জোট বেঁধে কী করেছে জানেন? দুর্গম এই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হেলিকপ্টারে করে ঘুরে ঘুরে মানুষকে বুঝিয়ে টিকা নিতে রাজি করিয়ে ফেলেছে।
হেলিকপ্টার কেন? যাতে লোকের কাছে পৌঁছতে এবং তাদের বোঝানোয় সময় নষ্ট না হয়।
আর আমরা হেলিকপ্টারে করে বিয়ের আয়োজন করি,হুজুর হেলিকপ্টারে করে ওয়াজে আসেন, নায়িকা শুটিং এ যান। ওরা তেল পুড়ে সময় বাঁচাতে আর আমরা তেল পুড়ি দেমাগের তেল ঝাড়তে।পোড়া কপাল, পোড়া দেশ!
অনেকেই বলবেন, ভুটান কম জনসংখ্যার দেশ। বাংলাদেশের সাথে জন সংখ্যার দিক দিয়ে এর কোনো তুলনাই চলে না।কিন্তু এটাও মাথায় রাখতে হবে, ছোট দেশের স্বাস্থ্য বাজেটও কম হয়। স্বাস্থ্য পরিষেবার পরিকাঠামোও ছোট। সর্বোপরি ভুটানে রেলপথ না রাখার ব্যাপারটা চিন্তা করা যেতে পারে।
কীভাবে দুর্গম অঞ্চলগুলোতে টিকা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে, সেই কথাটা।
গোটা ভুটানে ভাইরাল নমুনা পরীক্ষার জন্য মাত্র একটি পিসিআর মেশিন রয়েছে। ভুটানে চিকিৎসকের সংখ্যা ৩৩৭! এদের মধ্যে মাত্র একজনের অভিজ্ঞতা ছিল ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট সামলানোর। পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা ৩০০০!
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলে, কোনও দেশে রোগী এবং চিকিৎসকের সংখ্যার অনুপাত অন্তত ১০০০:১ হওয়া উচিৎ। ভুটানে অনুপাতটা ঠিক তাই।
কেন ভুটান পেরেছে? কেন আমরা পারছি না?
দুঃসময়ের চরমতম সময়ে আমাদের মাস্ক,পিপিই এর দুই নাম্বারির বিচার করতে হয়, তদন্ত করতে হয়।
আসল কথা হল পরিকল্পনা, সদিচ্ছা, দেশপ্রেম, আইন মানার প্রবণতা, বিজ্ঞান কে আমলে নিলে যে সমস্যা সমাধান সম্ভব তা আমাদের প্রতিবেশী রাস্ট্র ভুটান দেখিয়ে দিলো।
যে দেশটির অন্যতম আয়ের পথ পর্যটন। বাইরের লোক না এলে সে দেশের অনেক ঘরে চুলায় আগুন চলে না হাঁড়ি চড়া বন্ধ হয়ে যায়। তবু গত বছরের মার্চ থেকে কড়া হাতে বিদেশিদের আসা বন্ধ করে দিয়েছিল ভুটান। ভাগ্যিস, ভুটানে এই প্রশ্ন তোলার কেউ নেই, বাইরের লোক না এলে গরিবের পেটের ভাত কি আপনি খাওয়াবেন?
ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরে লোটিং বাংলাদেশের একটি সরকারী মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করা একজন চিকিৎসক। কিছুদিন আগে বাংলাদেশেও এসেছিলেন সরকারী সফরে।এবং বাড়ী ফিরে গিয়ে ছিলেন চৌদ্দদিন কোয়ারিন্টিনে।রাস্ট্রের সর্বোচ্চ পদে থেকেও আইনের প্রতি কী শ্রদ্ধা!অথচ আমাদের দেশের একজন নাগরিক বিদেশ থেকে এলে কোয়ারিন্টেনে রাখলে পালিয়ে যান, ‘ফাক ইউ’ বলে রাগ ঝাড়েন মিডিয়ায়,মটর সাইকেলে গার্লফ্রেন্ড কে নিয়ে এলাকায় ঘুরেন ‘আইলোরে নয়া দামান’ গান গেয়ে।
২০১৯-এর ৩১ ডিসেম্বর চিনে প্রথম করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। ভুটান করোনার বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে ২০২০-র ১৫ জানুয়ারি থেকে। মার্চ মাসের ৬ তারিখে ভুটানে ঘুরতে আসা এক মার্কিন বৃদ্ধের শরীরে প্রথম করোনার হদিস মেলে। তার ৬ ঘণ্টা ১৮ মিনিটের মধ্যে আক্রান্তের সংস্পর্শে আসা ৩০০ জনকে চিহ্নিত করে পরীক্ষা শুরু হয়। পাঠানো হয় আইসোলেশনে। এদিকে ওই বৃদ্ধকেও দেশে ফেরানো হয় ওই ৬ ঘণ্টা ১৮ মিনিটের সময়কালের মধ্যেই।
আর আমাদের দেশে কী হচ্ছে তো দেখতে পাচ্ছি? ভুটানের এই সাফল্যের পিছনে আছে গোটা দেশের মানুষ এবং অবশ্যই সরকারের সদিচ্ছা এবং তৎপরতা।
এরপরেও ভুটানের জনসংখ্যা কমের দোহাই দিলে হবে? তৎপরতা এবং সদিচ্ছা কিন্তু জনসংখ্যার ওপরে নির্ভর করে না। শুধু জনসংখ্যা কমের দোহাই দিয়ে এই সাফল্যকে ছোট করবেন না।
১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাকে মহামারী হিসেবে ঘোষণা করে। ঠিক তার পরপরই ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগায়েল ওয়াংচুক ঘোষণা করেছিলেন, ‘এই ধরনের অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে জনগণের সব দুর্ভোগ, দুর্দশার দায়িত্ব সরকার নেবে।’
ভুটানের সরকার এই ত্রাণের খাতে খরচ করেছিল ১৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। দেশের সমস্ত সরকারি কর্মচারীরা নিজেদের একমাসের বেতন দান করেছিলেন! বিনামূল্যে ফসল দান করেছেন দেশের চাষীরা, যাতে দেশের কেউ অভুক্ত না থাকেন। মন্ত্রীরা পরিস্থিতি সামাল দিতে দিনের পর দিন অফিসে থেকে গিয়েছেন। বাড়িও ফেরেননি। আর সেই মন্ত্রী এবং সরকারি কর্মচারীদের চা নাস্তা দিতে সন্ধেবেলা পৌঁছে যেতেন স্থানীয় মানুষরা।
ভুটানের প্রধানমন্ত্রী এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী লোটে শেরিং দেশের জনতার কাছ থেকে এই ব্যবহার পেয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে বলেছিলেন, ‘জনতাকে ধন্যবাদ। তাঁরা আমাদের মন জিতে নিয়েছেন। আমরাও কথা দিচ্ছি করোনার বিরুদ্ধে লড়াইটা জিতেই দেখাব। তার আগে এই সময়ে যাঁরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমাদের পাশে দাঁড়ালেন, তাঁদের অভিবাদন জানাই।’
শুধু মুখের কথায় সম্মান কিংবা অভিবাদন জানানোর লোক ভুটানের লোটে শেরিং নন। তিনি সপ্তাহে ৬দিন তিনি সরকারের কাজ করেন। এবং শনিবার তিনি সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা করেন। হ্যাঁ, লোটে একজন শল্যচিকিৎসকও বটে। মাত্র ৩৩৭ জন চিকিৎসকের দেশে সময় পেলেই চিকিৎসা দেন তিনি। এবং ২০১৩ সাল থেকেই তিনি সদলবলে ভুটানের প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে বিনাপয়সায় চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। আর হ্যাঁ, এর পাশাপাশি প্রতি বৃহস্পতিবার তিনি দেশের উঠতি চিকিৎসকদের ক্লাসও নেন। একথা সত্যি, ভুটানের জনসংখ্যা কম। কিন্তু এটাও সত্যি কম জনসংখ্যার পাশাপাশি কম চিকিৎসকের অভাবপূরণ করতে সেদেশের প্রধানমন্ত্রী এই করোনার সময়েও ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা হিসেবে একেবারে সামনে থেকে লড়ছেন।
সেই ভুটান এবার গোমূত্রে করোনা সারে কিনা এই বিতর্কে ব্যস্ত ভারতের মতো বড় দেশকে প্রতিদিন ৪০ মেট্রিক টন তরল অক্সিজেন সরবরাহ করবে! বাংলাদেশ বিপদে পড়লে স্বাধীন বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দানকারী রাস্ট্র ভুটান হয়তো বাংলাদেশকেও কয়েক টন অক্সিজেন দিবে।
পিঁপড়া নাকি তার ওজনের ছয়গুন ওজন বহন করতে পারে। আর ভুটান এ উপমহাদেশে সে উদাহরণই স্থাপন করেছে। স্রেফ পরিকল্পনা এবং দেশপ্রেমের জোরে এরা নিজেদের কোথা থেকে কোথায় নিয়ে গেছে!
ডাক্তার সেলিম শাহেদ
রেজিস্টার (মেডিসিন)
শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিকেল কলেজ