আফছার হোসাইন কায়রো (মিসর) থেকে
বি-দেশ নিউজ স্পেশাল ৯ মার্চ ২০২২:
আদ্দিকাল থেকেই দেশ হিসেবে মিসর আর তার সভ্যতা নীল নদের ওপর নির্ভরশীল। মিসরের প্রায় সবকিছু; সাংস্কৃতিক থেকে শুরু করে সামাজিক পথপরিক্রমা এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোও সে অর্থে নীলনদের তীর ঘেঁষেই। সব মিলিয়ে মিসর মানে যেমন পীরামিড আর নীল নদ; তেমনি নীল নদ কয়েকটি দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও বিশ্বজুড়ে মানুষ নীল নদকে চেনে মিসর দেশটির পরিপূরক হিসেবে। অথচ ক’জন জানে যে এই নীল নদের পেছনে দারুণ একটা গল্প আছে?
যেহেতু মিসরীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি ও তাদের উন্নয়ন এই নদের ওপর নির্ভরশীল তাই এই নদের পানি প্রবাহ নিয়ে বরাবরই তাদের আগ্রহ। জানা গেছে, এক সময় নিয়মিত পানি প্রবাহের জন্য নীল নদে সুন্দরী নারীদের উৎসর্গ করা হতো! তার কারণও আছে, ৬৪০ খ্রিষ্টাব্দের আগ পর্যন্ত নীল নদ প্রতি বছর শুকিয়ে যেত। সেসময় মিশরীয়রা এই কুসংস্কার মেনে চলত।
জানা গেছে; শুকিয়ে যাওয়া নদীতে কোনো ষোড়শী সুন্দরী এবং অতিঅবশ্যই কুমারী মেয়েকে অলংকার ও সুন্দর পোশাক পরিয়ে নীল নদের শেষ সীমানায় ভাসিয়ে দেওয়া হতো (যে সীমানায় পানি থাকত)! তাদের ধারণা ছিল নীল নদকে উপহার দিয়ে সন্তুষ্ট করতে হবে, নয়তো নীল নদ আর পানি প্রবাহ করবে না। এই নিষ্ঠুর নারী বলি প্রথা মিসরে যুগ যুগ ধরেই চলেছে।
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ফারুখ (রাঃ) খেলাফতের সময় বিখ্যাত সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে’ আমর ইবনুল আস (রাঃ)র নেতৃত্বে ইসলাম কায়েমের জন্য ৬৪০ খ্রিষ্টাব্দে যখন মিশর বিজয়ী হলো। তিনি নীল নদের এই নারী বলি দেয়ার ঘটনায় খুব মর্মাহত হন। মিশরীয় একদল লোক প্রতি বছরের মতো সেবারও যখন নারী বলি দেয়ার অনুমতি আনতে বিখ্যাত সাহাবি হজরত আমর ইবনুল আস (রাঃ) কাছে গেলো তখনই জানালেন, ইসলাম এ ধরণের কুসংস্কার সমর্থন করে না। অন্যায়ভাবে কোনো মানুষের জীবন এভাবে জলাঞ্জলি দেয়া ইসলামে বৈধ হবে না। এটি ইসলাম ছাড়াও তিনটি আসমানি ধর্মই সমর্থন করে না। কোথাও এভাবে নারী বলি দেয়ার নিয়মের বৈধতা দেওয়া নেই।
সে বছর ঘটনাক্রমে দেখা গেল, নীল নদে পানি আসেনি। তখন চাষাবাদের সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতি হয়। এমনকি যাদের পেশা চাষাবাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে শুরু করে। আবার অনেকেই পুনঃরায় নীল নদকে সন্তুষ্ট করতে এক কুমারীকে উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নেয়। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে’ আমর ইবনুল আস (রাঃ) তৎক্ষণাত চিন্তিত হয়ে খলিফা হজরত ওমর ফারুখ (রাঃ) কাছে সমাধান চেয়ে বিশেষ দূত পাঠান।
সব ঘটনা জানতে পেরে খলিফা কুমারী উৎসর্গ করার রীতি বন্ধ করায় খুশি হন এবং সাহাবিকে ধন্যবাদ জানান। মহান আল্লাহ তায়ালার নামে একটি পত্র লিখেন খলিফা হজরত ওমর (রাঃ)। এরপর তিনি দূতের মাধ্যমে মিসরের সাহাবি হজরত আমর ইবনুল আস (রাঃ) কাছে পত্রটি পাঠান। পত্রের মধ্যে ছিল ছোট্ট একটি চিরকুট। আর পত্রে লেখা ছিল শুকিয়ে যাওয়া নীল নদের মাঝখানে চিরকুটটি রেখে দ্রুত চলে আসতে।
খলিফা হজরত ওমর ফারুখ (রাঃ) এর নির্দেশ অনুযায়ী, চিরকুটটি সাহাবি হজরত আমর ইবনূল আস (রাঃ) নীল নদের মাঝখানে রেখে আসেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, চিরকুটটি রেখে আসার সঙ্গে সঙ্গেই নীল নদ পানিতে পূর্ণ হতে শুরু করল। সেই থেকেই নীল নদের পানি প্রবাহ শুরু হয়ে আজো তা প্রবাহমান রয়েছে।
সেই চিরকুটে খলিফা হজরত ওমর ফারুখ (রাঃ) কী লিখেছিলেন? সেই চিরকুটটি খলিফা হজরত ওমর ফারুখ (রাঃ) নীল নদের উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন। জানতে পারা গেছে ওতে লেখা ছিল, আল্লাহর বান্দা, মুমিনগণের আমীর খলিফা হজরত ওমর ফারুখ (রাঃ) পক্ষ থেকে মিসরের নীল নদের প্রতি, “তুমি যদি তোমার ইচ্ছায় প্রবাহিত হও। তবে তোমার প্রবাহিত হবার কোনো প্রয়োজন নেই। আর যদি তোমার জারি হওয়ার, প্রবাহিত হওয়ার ক্ষমতা মহান আল্লাহ তায়া’লার পক্ষ থেকে হয় তবে মহান রাব্বুল আল-আমিনের দরবারে মিনতি জানাই। তিনি যেন তোমাকে জারি করে দেন।”
আধ্যাত্নিক ক্ষমতার অধিকারী খলিফা হজরত ওমর ফারুখ (রাঃ)র সেই চিরকুটের দ্বারা নীল নদের সেই সমস্যা আজীবনের জন্য দূরীভূত হয়। এতে বহু যুবতী নারীর প্রাণ রক্ষা পায়। মিসরবাসী অনেক বড় কুসংস্কারের হাত থেকে চিরজীবনের মতো মুক্ত হয়।
এরপর থেকেই মিসরের নীল নদে সারা বছরই পানির প্রবাহ থাকে।
এ জাতীয় আরো খবর..