দ্বিতীয় দফা আন্দোলন শুরু হয়েছিল চলতি বছরের পয়লা জুলাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা বাতিলের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে ছাত্রসমাবেশ ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। চলতি বছরের ৫ জুন সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত ও আধাস্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে (নবম থেকে ১৩তম গ্রেড) মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন আদালত। এর পরদিন পরিপত্র বাতিলের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা।
মূলত এ দিনেই কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় দফা আন্দোলনের বীজ বপন হয়। কোটা সংস্কারের দাবিতে দীর্ঘ ৩৬ দিনের আন্দোলনে যা যা ঘটেছে তা থাকছে এই টাইমলাইনে :
৫ জুন ২০২৪, বুধবার
২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর কোটা বাতিল করে জারি করা সরকারি পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় প্রদান করেন হাইকোর্ট। এতে সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত ও আধাস্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন করপোরেশনের নবম থেকে ১৩তম গ্রেডের সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগের ক্ষেত্রে আর বাধা থাকল না।
৬ জুন, বৃহস্পতিবার
হাইকোর্টের বাতিলকৃত পরিপত্র বাতিল করে দেওয়া রায় বাতিলের দাবিতে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ’-এর ব্যানারে বিক্ষোভ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
৯ জুন, রবিবার
হাইকোর্টের বাতিলকৃত পরিপত্র বাতিল ও সরকারি চাকরিতে মেধাভিত্তিক নিয়োগ বহাল রাখার দাবি ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বিক্ষোভ সমাবেশ হয় চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়েও। শিক্ষার্থীরা তাঁদের দাবি মানতে সরকারকে ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন। এই সময়ের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে সর্বাত্মক আন্দোলনের ঘোষণা দেন তাঁরা।
১ জুলাই, সোমবার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা বাতিলের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে ছাত্রসমাবেশ ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে ৪ জুলাইয়ের মধ্যে দাবির বিষয়ে চূড়ান্ত সুরাহার আহ্বান জানিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে তিন দিনের কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়।
২ জুলাই, মঙ্গলবার
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে অনুষ্ঠিত হয় মিছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অধিভুক্ত সাত কলেজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজধানীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যোগ দেয় মিছিলে। মিছিলটি নীলক্ষেত, সায়েন্স ল্যাবরেটরি ও বাটা সিগন্যাল মোড় ঘুরে শাহবাগে গিয়ে থামে। একই দিন বিকেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ২০ মিনিটের জন্য অবরোধ করেন।
৩ জুলাই, বুধবার
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ঢাকার শাহবাগ মোড়, ময়মনসিংহের কয়েকটি সড়ক ও রেললাইন, ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক, চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়ক এবং বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে সংশ্লিষ্ট এলাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে।
৪ জুলাই, বৃহস্পতিবার
আপিল বিভাগে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণার বিষয়ে শুনানির তারিখ নির্ধারিত ছিল এদিন। তবে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগ ‘নট টুডে’ বলে আদেশ দেন। পরের সপ্তাহে এ বিষয়ে শুনানি হতে পারে বলে ওই দিন অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় থেকে জানানো হয়। এদিন শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন মহাসড়ক অবরোধ করে। আর ঢাকায় শাহবাগ মোড় অবরোধ করে রাখে পাঁচ ঘণ্টা। এদিন ছাত্রসমাবেশ থেকে ছাত্রধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়।
৫ জুলাই, শুক্রবার
চট্টগ্রাম, খুলনা ও গোপালগঞ্জে সড়ক অবরোধ করে আন্দোলনকারীরা। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে পরদিন সারা দেশে বিক্ষোভ ও অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
৬ জুলাই, শনিবার
সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন, ছাত্রধর্মঘট এবং সারা দেশে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধের ডাক দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা। এই কর্মসূচির নাম দেওয়া হয় ‘বাংলা ব্লকেড’। এদিন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হয়।
৭ জুলাই, রবিবার
শিক্ষার্থীদের বাংলা ব্লকেড কর্মসূচিতে স্থবির হয়ে পড়ে রাজধানী। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেয় শিক্ষার্থীরা।
৮ জুলাই, সোমবার
‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ প্ল্যাটফরম ৬৫ সদস্যের সমন্বয়ক টিম গঠন করে। সমন্বয়ক কমিটির সদস্য নাহিদ ইসলাম সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে শুধু সংবিধান অনুযায়ী অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যূনতম কোটা রেখে সংসদে আইন পাসের দাবি জানান। এদিন ঢাকার ১১টি স্থানে, ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে, তিনটি স্থানে রেলপথ অবরোধ এবং ছয়টি মহাসড়কে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি পালিত হয়।
৯ জুলাই, মঙ্গলবার
হাইকোর্টের পরিপত্র বাতিলের রায় স্থগিত চেয়ে দুই শিক্ষার্থী আপিল বিভাগে আবেদন করেন। পরদিন শুনানির তারিখ নির্ধারণ করা হয়। যদিও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা দাবি করেন, ওই দুই শিক্ষার্থীর আবেদন করার সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্পর্ক নেই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে পরদিন সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে আবারও অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়।
১০ জুলাই, বুধবার
কোটা বাতিলের পরিপত্র বাতিল চেয়ে সরকারের আবেদনসহ সব বিষয়ে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে নির্দেশ দেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগ। শুনানির তারিখ নির্ধারণ করা হয় ৭ আগস্ট। শুনানির এক পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘আমরা এই সমাজের মানুষ, কিছু কথা বলতেই হয়। সেটি হচ্ছে যে একটা রায় হাইকোর্টে হয়ে গেছে। ছাত্র-ছাত্রীরা আন্দোলন করছে। সেখানে তারা যেটা করেছে, এটা অ্যাপ্রিশিয়েট (প্রশংসা) করার মতো না। ম েন হয় তারা ভুল বুঝেই করেছে। যা-ই হোক, যেটিই করেছে, তারা আমাদেরই ছেলেমেয়ে।’ এদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হয়ে শাহবাগ অবরোধ করেন। টানা অবরোধ কর্মসূচিতে স্থবির হয়ে পড়ে সারা দেশ। রাজধানীর সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
১১ জুলাই, বৃহস্পতিবার
বিকেল ৩টা থেকে শাহবাগ অবরোধের কথা থাকলেও বৃষ্টির ফলে শিক্ষার্থীরা শাহবাগে যাওয়ার পথে পুলিশের বাধা অতিক্রম করে সাড়ে ৪টায় শুরু করে। এদিন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ হামলা করে। রাত ৯টায় শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শেষ করে তাদের ওপর পুলিশি হামলার প্রতিবাদে ১২ জুলাই বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের ঘোষণা দেয়।